মুক্তিযুদ্ধ দেখা হয়নি এই তরূণ প্রজন্মের, শোনা হয়েছে শুধু গল্প। তবে গল্প বলার মানুষগুলোর মাঝে অনেকেই চলে যাচ্ছেন নিভৃতেই। উৎসবের ৬ষ্ঠ দিনে সৌভাগ্যবশত করোনাকালীন এই কঠিন সময়েও আমরা আমাদের মাঝে পেয়েছি এমন কিছু বীর মুক্তিসেনাদের। তাঁরা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্ণেল কাজী সাজ্জাদ আলি জহির,বীরপ্রতীক, মোহাম্মদ মাশরুকুল হক ও মাশরুকুল হক নীরা। সুযোগ হয়েছিলো তাঁদের খুব কাছ থেকে মুক্তির গল্প শোনার।
লে. কর্ণেল কাজী সাজ্জাদ জহির শোনালেন যুদ্ধকালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প। শোনালেন মাহালী সম্প্রদায়ের পাকবাহিনীর ভয়ে দিনের পর দিনের গহীন জঙ্গলে গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকার গল্প, রেবাতী মাহালীর দুঃসাহসিকতার গল্প, যা অমর হয়ে আছে মাহালী সম্প্রদায়ের মাঝে, যার সৎকার করা হয়নি সম্মানের সাথে। যেই গাছটির পিছে রেবাতী মাহালীকে নির্যাতন করা হয়েছিল, সেই গাছ এখনো ভিজে আছে তাঁর রক্তে; এমনটাই বিশ্বাস করেন সাজ্জাদ আলি জহির। একজন মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক হিসেবে তিনি নিজের ক্ষমতায় যতোটুকু পেরেছিলেন, করেছেন তাঁদের জন্য। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও কেউ ভুলে যায় তাঁর অবদানের কথা। তিনি বললেন, “৩৬ বছর পর আমি আবার গেলাম। দেখলাম সেই বিশাল গাছটি এখনো আছে, টিলাটি আছে, সুন্দর বসতি হয়ে গেছে। বসতির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন থিবাস মাহালী, মাহালীদের সরদার। একাত্তরের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর। লোকটি আমার কথা মনে রেখেছিল। উনি আমাকে ‘মুক্তি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। বৃদ্ধরা সকলেই রেবাতী মাহালীকে স্মরণে রেখেছিলেন।” আরও বললেন মুক্তিবাহিনীকে নির্মমভাবে শিরচ্ছেদে করে হত্যা করার গল্প। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শেষে গর্বের সাথে তুলে ধরলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মাশরুকুল হক শোনালেন যুদ্ধযাত্রায় তাঁর প্রতিকূলতার গল্প। তিনি বললেন, “একাত্তরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে তখন দূরত্বের সৃষ্টি হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা মানুষগুলোর সাথে একটি নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে আমরা সবাই এক, আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক। তাই কোন কষ্টই আর কষ্ট মনে হয়নি, সৌভাগ্য মনে হয়েছে।”
মারুফা মাশরুক নীরাও ভাগাভাগি করে নিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। সম্মুখ সমরে না থাকলেও স্বচক্ষে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। বললেন, “নিত্যদিনের হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন দেখতে দেখতে ভয় ব্যাপারটা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।” ঢাকা থেকে পাকসেনার ভয়ে পাবনায় যাওয়া এবং পাবনায় নানাবাড়িতে হামলা হওয়ার পর পরিবারের সকলের জীবন বাঁচাতে বনে-বাঁদাড়ে আশ্রয়ের গল্প শোনালেন তিনি। বললেন, “একাত্তরের সময় গ্রামের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা যেন খরার সময় বৃষ্টির পানির মতো।” গ্রেনেড সাজানো থেকে আরম্ভ করে লিফলেট হাতে হাতে পৌঁছে দেয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিলেন মারুফা মাশরুক।
লে. কর্ণেল সাজ্জাদ আলী জহিরের সেই কথাটিই যেন ভাসছিল চোখের সামনে পুরো সেশনজুড়ে। এরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা, যাঁদের বুকের ওপর লাগানো আছে লোহার পাত। সেই লৌহকঠিন পাতে আটকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল নির্যাতকের দল।
- সামিরা সিফাত স্বর্ণা