যে অগ্রজদের হারিয়েছি …

এই পৃথিবীতে কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। আর এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে আলো নিয়ে আসা মানুষগুলো যখন বিদায় নেয় চিরদিনের জন্য, তখন তাদের আলোর পথকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া এবং সেই আলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াটাই জীবনের এক উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। আমার লেখাটি তাদের নিয়ে যাদের ভালবাসা এবং শুভ কামনা সবসময় আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে ছিল। তাঁরা আজ আমাদের মাঝে নেই তবে তাঁদের দেওয়া শিক্ষা আমাদের সাথে আজীবন থাকবে…

আবু তারেক মাসুদঃ 

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আবু তারেক মাসুদ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বাংলাদেশি স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার।তাঁর পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫) এবং প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না (২০০২) । ২০০২ সালে মাটির ময়না  চলচ্চিত্রটির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং এটি প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কারের (অস্কার) জন্য নিবেদিত করা হয়। তাঁর সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে (২০১০)। চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। তিনি দীর্ঘদিন ‘চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি’র উপদেষ্টা ছিলেন। তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর ২০১২ সালে বিভিন্ন সময়ে লেখা তার চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে একটি বই প্রকাশিত হয় ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নামে। তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হল আদম সুরত, ভয়েসেস অফ চিলড্রেন, নারীর কথা, অন্তর্যাত্রা  ইত্যাদি। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট কাগজের ফুল নামক চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন দেখার জন্য তারেক মাসুদ তার সহকর্মীদের নিয়ে মানিকগঞ্জের সালজানা গ্রামে যাওয়ার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। 

মিশুক মুনীরঃ 

আশফাক মুনীর চৌধুর ছিলেন একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক। তিনি বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ পরিচালিত ছবি রানওয়ে’র প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। মিশুক মুনীরকে ‘বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ’ বলা হয়। তিনি ২০০১ সাল পর্যন্ত একুশে টিভির বার্তাপ্রধান (পরিচালনা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে কানাডীয় সাংবাদিক পল জেয়োর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক সংবাদ টেলিভিশন রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক। সম্প্রচার-সাংবাদিকতার রূপকার মিশুক মুনীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসির ভিডিওগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি সর্বশেষ ২০১০ সালে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া তিনি রিটার্ন টু কান্দাহার, ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম  প্রামাণ্যচিত্রগুলোতেও কাজ করেছেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়ে ফেলি মিশুক মুনীরকে। একই দুর্ঘটনায় চলে যান তারেক মাসুদও।

 

আলী যাকেরঃ

 

বাংলাদেশী অভিনেতা, ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট ছিলেন আলি যাকের। দুটি বিখ্যাত ধারাবাহিকবহুব্রীহি (১৯৮৮) এবং আজ রবিবার (১৯৯৯)-এ তিনি দর্শকের প্রিয় মুখ ছিলেন। 

১৯৭২ সালের আলী যাকের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ , ম্যাকবেথ, নূরুলদীনের সারাজীবন  সহ বহু মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি নদীর নাম মধুমতী এবং লালসালু সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আলী যাকের বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি-র কর্ণধার ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে  ভূষিত করে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর সকালে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন আলি যাকের। ওপারে ভাল থাকবেন, বড় চাচা। 

আনিসুজ্জামানঃ

বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন আনিসুজ্জামান। তিনি ভাষা আন্দোলন , উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।  বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আনিসুজ্জামান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে নিয়োগ দেয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্তে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক  এবং ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০২০ সালের ১৪ মে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত এবং হৃদরোগসহ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারনে চলে যান না ফেরার দেশে।

মোহাম্মদ খালেদ হোসেনঃ     মোহাম্মদ খালেদ হোসেন ছিলেন একজন দুঃসাহসী পর্বতারোহী।  সরকারি অনুদানে নির্মিত জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্প অবলম্বনে তৈরি কাজলের দিনরাত্রি (২০১৩) নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ খালেদ হোসেন।

২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ থেকে দ্বিতীয়বারের মত এভারেস্ট অভিযানে বের হয়ে, নেপালের সাউথ ফেস দিয়ে ২০ মে সকাল আনুমানিক ১০টায় এভারেস্ট জয় করেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট জয় করে নামার পথে ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায় অজানা কারণে মারা যান তিনি৷ এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মৃত্যুবরণকারী প্রথম বাংলাদেশী তিনি।

ফজলে হাসান আবেদঃ

বাংলাদেশি সমাজকর্মী এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। তিনি ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন পদ থেকে অব্যাহতি নেন এবং চেয়ার এমেরিটাস পদ গ্রহণ করেন। সামাজিক নেতৃত্বের জন্য র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান ১৯৮০ সালে। দারিদ্র‍্য বিমোচনে বিশেষ ভূমিকার জন্য ব্রিটেন কর্তৃক ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘নাইটহুডে’ ভূষিত করা হয়। গেটস ফাউন্ডেশনের  বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের নোবেল বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার লাভ করেছেন। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত অবস্থায় ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

 

নার্গিস জাহান বানুঃ

‘প্রশিকা’র সিনিয়র পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য নার্গিস জাহান বানু। তিনি শিলালিপি  চলচ্চিত্রের প্রডাকশন ম্যানেজার ছিলেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

মোস্তফা কামাল সৈয়দঃ

 টিভি ব্যক্তিত্ব ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান ছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। 

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোস্তফা কামাল সৈয়দ গত ১১ মে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৭৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

 

– সামিরা সিফাত স্বর্ণা

0 Comments

Leave a reply

© 2023 Children's Film Society Bangladesh

This website is designed & supported by Hootum Bangladesh Limited

Log in with your credentials

Forgot your details?