জানুয়ারির ৩০ তারিখ। সারা শহর উৎসবের পোস্টারে রঙিন করে মোড়ানো, সাজ সাজ রব মূল উৎসব-প্রাঙ্গণ শাহবাগের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্ষুদে চলচ্চিত্র নির্মাতারা পরিচিত হয়ে নিচ্ছে একে অন্যের সাথে, ব্যস্ত পায়ে ঘুরছে ছোট-বড় স্বেচ্ছাসেবক আর আয়োজকরা। এবারের উৎসবের থিম ছিলো পাহাড়, কাজেই উৎসবপ্রাঙ্গণের চারদিকেই দেখা যাচ্ছিলো সবুজ রঙা হাসি হাসি মুখের পাহাড় আর তার সাথে আনন্দে মেতে ওঠা শিশু আর পশু-পাখির ছবি। যেদিকেই তাকাই, মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির সাথে এক অপূর্ব আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠেছে শিশুরা। উৎসবের আগমনীবার্তা আসলো বরাবরের মতোই ঢাকের শব্দে। চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বাদশ আসর উদ্বোধন হলো অন্যান্যবারের মতোই শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে আর উৎসব সঙ্গীত ‘আলো আমার আলো’ গেয়ে। দুই ক্ষুদে স্বেচ্ছাসেবকের উপস্থাপনায় প্রধান অতিথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এম.পি এবং বিশেষ অতিথি মাননীয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের আগমন ঘোষণার পরপরই শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। উৎসব সঙ্গীতের পর প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথিকে নিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা, উৎসব পতাকা ও চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি’র পতাকা উত্তোলন করেন চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ -এর অনুষ্ঠান সম্পাদক রায়ীদ মোরশেদ এবং উৎসব পরিচালক ফারিহা জান্নাত মীম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় একই উৎসব-কেন্দ্রের শওকত ওসমান মিলনায়তনে। এ পর্বে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের যাত্রা শুরু করা হয়। স্বাগত বক্তব্যে চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ -এর অনুষ্ঠান সম্পাদক রায়ীদ মোরশেদ অতিথিদের স্বাগত জানান এবং আর্থিক সহযোগিতার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বিশেষ অতিথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এম.পি বলেন, “এটি ক্ষুদে বন্ধুদের একটি অসাধারণ আয়োজন। শিশুদের মেধা ও মনন বিকাশে চলচ্চিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। উৎসবে শিশুদের প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আশা করি এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও বজায়ে থাকবে।”
প্রধান অতথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এম.পি বলেন, “এই উৎসব আমাকে আগামী প্রজন্ম নিয়ে আশাবাদী করে। ছোটদের এত বড় আয়োজন আমাকে অবাক করেছে। এরকম উৎসব অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। ছবি বানানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। আমাকে একটি ছবি বানাতে বলা হলে আমি পারবো না, কিন্তু শিশুরা এখানে ছবি বানিয়ে ফেলছে। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখান থেকে অনেক প্রতিভা উঠে আসবে। পরবর্তী প্রজন্মকে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে এবং দেশমাতৃকার কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত করতে এই উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
এর পর উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন উৎসব পরিচালক ফারিহা জান্নাত মীম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে উৎসবের প্রথম প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয় পোলিশ চলচ্চিত্র ‘ট্রিপল ট্রাবল’।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন থেকে ৩টি ভেন্যুতে ৪টি করে নিয়মিত প্রদর্শনী শুরু হয়। প্রদর্শিত হয়েছে ৩৭টি দেশের ১৭৯টি চলচ্চিত্র। প্রদর্শনী হয়েছে মূল উৎসবকেন্দ্র গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনের পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে। মহামারীর এই কঠিনতম সময়ে উৎসব হয়েছে পূর্ব-ঘোষণা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে এবং সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে। প্রতিটি প্রদর্শনীতে মিলনায়তনগুলো প্রস্তুত করা হয়েছিলো সামাজিক দুরত্ব মেনে বসার মতো করে, অর্থাৎ একজন দর্শকের দু’পাশে একটি করে আসন ফাঁকা রেখে। এ ছাড়াও এবারের উৎসবে মাস্ক পরিধানকে বিবেচনা করা হয়েছে সিনেমার টিকিট হিসেবে। এ ছাড়া প্রত্যেক উৎসবকেন্দ্রে হাত জীবানুমুক্তকরণ ও তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা ছিলো মূল প্রবেশপথ ও মিলনায়তনের বাইরে।
উৎসবে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিশু, কিশোর ও তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য ছিলো কর্মশালা-সহ নানা আয়োজন। উৎসবের প্রথম দিনই ছিলো প্রতিনিধিদের পরিচিতি পর্ব। নানা মজার খেলা আর কর্মকান্ডে বরাবরের মতোই এই অংশটিতে প্রতিনিধিদের মাতিয়ে তোলেন উৎসবের স্বেচ্ছাসেবক জিহাদ। দ্বিতীয় দিন থেকেই শুরু হয় কর্মশালা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডা সেশন। ৩১ জানুয়ারি চিত্র্যনাট্য লিখনের ওপর কর্মশালা নেন সাদিয়া খালিদ রীতি। একই দিনে প্রতিনিধিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেরশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদার। ১ ফেব্রুয়ারি প্রোডাকশন ডিজাইনিং নিয়ে কর্মশালা নেন রঞ্জন রব্বানী এবং ২ ফেব্রুয়ারি চিত্রপরিচালনা ও চিত্রগ্রহণ নিয়ে কর্মশালা নেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব এবং সুনিধি নায়েক অন্তরঙ্গ আড্ডায় উপস্থিত হন সেদিন সন্ধ্যায়ই। উৎসবের শেষ কর্মশালায় ফেস্টিভ্যাল সার্কিট নিয়ে কথা বলেন আবু শাহেদ ইমন। ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রতিনিধিদের সাথে একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধের গল্পে মেতে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধা মাশরুকুল হক, মারুফা মাশরুক নিরা এবং কর্ণেল সাজ্জাদ জহির। উৎসবের শেষ দিন ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধিদের হাতে সনদপত্র তুলে দেবেন চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ -এর সভাপতি মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নাম ঘোষণা করা হবে। এই অনুষ্ঠানেই তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে ক্রেস্ট, সনদপত্র এবং আর্থিক অনুদানের চেক। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী।
উৎসবের আয়োজন নিয়ে এবার ছিলো নানা শঙ্কা। মহামারীর কারণে আয়োজনের ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে হয়েছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। তবে সকল কিছুর পরেও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি ১৩ বছরের ধারাবাহিকতা। সকল কিছু সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে শেষ করে আজ পর্দা নামতে যাচ্ছে ১৪তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবের। আরো একটি আসরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো একটি বছর, কিন্তু আজ বাড়ি ফেরার সময় সকল আয়োজক আর ক্ষুদে নির্মাতারা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে কিছু স্মৃতি, কিছু বন্ধুত্ব আর বুকভরা আনন্দের ছবি। যে ছবির পুরোটুকুই অপার সম্ভাবনায় মোড়া। যে ছবির ফ্রেমে ফ্রেমেই তৈরি হবে আগামী স্বপ্ন।
– ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী