২০০৯ সালের নভেম্বর মাসের ঘটনা।
কোলাহলপূর্ণ একদম নন-কর্পোরেট একটি অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকলো তেরো চোদ্দ বছরের ছেলেটি। আশ্চর্য! এখানে প্রায় সবাই তারই বয়সী অথচ কি স্বাচ্ছন্দ্যে ছেলে মেয়েরা একসাথে হাসি ঠাট্টা করছে! ছেলেটা ঠিক এরকম পরিবেশ কল্পনা করে আসে নি। মিটিং রুমের কোণায় বসতে বসতে পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো এটাই ‘চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি, বাংলাদেশ’ এর অফিস। সাধারণত কোনো অর্গানাইজেশনের নামের শেষে ‘সোসাইটি’ শব্দটা থাকলে নামের একটা ভারিক্কী চলে আসে। তবে একদল কিশোর কিশোরীর চিল্লাপাল্লায় ভারিক্কী এখানে গুম হয়ে গেছে!
প্রথম থেকেই ছেলেটির মনে হচ্ছিলো এটা তার জায়গা না। পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোনো কাজে সে পারদর্শী ছিলো না, এই কথাটাও ঠিক হবে না। কারণ সে পড়াশোনাতেও ছিলো চরম ফাঁকিবাজ! যেই ছেলে ঠিকঠাক মতো নিজের হোমওয়ার্কই শেষ করতে পারে না সে কিভাবে পারবে এতো বড় একটা চলচ্চিত্র উৎসবে কাজ করতে! তখন পর্যন্ত নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে সর্বোচ্চ স্কুলে যাওয়া ও বাড়ি ফেরা ছিল ছেলেটার একমাত্র কাজ। সেখানে হুট করে এত বড় উৎসব পরিচালনায় কাজ করা রীতিমত এভারেস্ট জয়ের সমতুল্য!
মিটিং হলো শুরু!
মিটিং শুরুর সাথে সাথে সাধারণত সবাই চুপ করে হঠাৎ গম্ভীর মুখ আনার চেষ্টা করে। কিন্তু এখানে সবকিছুই যেনো বাচ্চাদের দখলে! মিটিং শুরু হওয়ার সাথে সাথে সবার উত্তেজনা যেন গলার স্বরেই ঝড়ে পড়লো! এই উত্তেজনা অহেতুক না। কারণ মিটিং রুমে এ কোনো কালো স্যুট-কোট পড়া, চোখে কালো চশমা দিয়ে বিজনেসম্যান টাইপের কেউ ঢুকলো না। ঢুকলো সবার প্রাণপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল, প্রিয় চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, মিনা কার্টুনের জনক মুস্তাফা মনোয়ার এবং সবার প্রিয় মানুষ, যিনি সব বাচ্চাদের নিজের ছেলে মেয়ের মতো দেখেশুনে রাখেন সেই মুনিরা মোরশেদ মুন্নী! এইটা তো আসলে কোনো মিটিং না! এটাই একটা উৎসব! অনেক অনেক মজার আড্ডা, খাওয়া দাওয়ার মাঝে শেষ হলো ‘৩য় আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব, ২০১০’ এর মিটিং!
মিটিং শেষে ছেলেটা সবার অগোচরে বের হয়ে যেতে নিবে এমন সময় এক মেয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে এসে ছেলেটিকে বললো, “আমি অরণি সেমন্তী! তোমার নাম কি?” এই মেয়েটিই ছিলো তথাকথিত এই সোসাইটি নামক প্রাণের উৎসবের প্রথম বন্ধু। তারপর কতো জনের সাথেই না ছেলেটার পরিচয় হলো! দুয়েক কথাতেই সবাই কেমন আপন হয়ে যায় এখানে! এটাই বুঝি বাচ্চাকালের সবথেকে বড় শক্তি! সবাইকে আপন করে নেয়া যায় নিমিষেই।
সপ্তাহে সপ্তাহে মিটিং হতে থাকলো আর উৎসব এগিয়ে আসলো। জানুয়ারির ২৩ থেকে ২৯ তারিখ, সাত দিনের উৎসব শুরুর বাকি আছে তখন আর সপ্তাহ চারেক। ছেলেটার দায়িত্ব পড়লো অডিটোরিয়াম কন্ট্রোল সেক্টরে! নাম শুনে প্রথমে ছেলেটা ভাবছিলো এখনো টিভিতে প্রিয় কার্টুন শুরুর বেশ কিছু সময় হাতে আছে, বাসায় চলে যাবে কিনা। পরে আর যাওয়া হলো না। রয়ে গেলো প্রাণের উৎসবের অপেক্ষায়।
উৎসব শুরুর আগে আগে ছেলেটার গলায় ঝুললো লাল ফিতার ভলান্টিয়ার আইডি কার্ড। সেই কার্ডটা যেনো সোনার হরিণ ছিলো ছেলেটার কাছে! পারলে প্রতিদিন গোসল করার সময়ও কার্ডটাকেও সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে লোশন লাগায় ছেলেটা!
উৎসব হলো শুরু!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলেন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে। সাথে আসলেন দেশের গণ্যমান্য আরো অনেক প্রিয় মানুষেরা! চারিদিকে সিকিউরিটি প্রটোকল! গলায় আইডি কার্ড! মনে হচ্ছিলো হলিউডের কোন ফিল্মের শ্যুটিং শুরু হতে যাচ্ছে! এখনি হয়তো ক্যামেরার ওপাশ থেকে পরিচালক ‘এ্যাকশন’ বলে চিৎকার করে উঠবে! হ্যাঁ, ছেলেটার জীবনে এখান থেকেই শুরু হলো এক নতুন চলচ্চিত্র!
সাত দিনের আনন্দ উৎসব শেষে আসলো বিদায় পালা। এই পালাটুকু স্ক্রিপ্ট থেকে কেটে দিলে মনে হয় চলচ্চিত্রটা আরো আনন্দঘন হতো। তবে সব আনন্দেরই শেষ আছে। যাতে নতুন আনন্দ আরো বড় করে জীবনে আসতে পারে।
পালাক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম উৎসব শেষ হলো। যেই ছেলেটা একসময় রুমের কোণায় বসেও ইতস্তত করতো সেই ছেলেটাই যথাক্রমে assistant festival programmer হলো, ষষ্ঠ উৎসবে হলো বিচারক। এই ছেলেটা আর সেই ছেলেটা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, এই উৎসবের সাথে পড়াশোনার কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও এই উৎসবে যোগদানের পর থেকে ছেলেটার পড়াশোনাও ভালো দিকে যেতে থাকলো! এবং একসময় যখন শুধু ‘টম এন্ড জেরি’ কিংবা ‘স্পঞ্জবব স্কয়ারপ্যান্টস্’ দেখেই দিনরাত এক করে ফেলতো ছেলেটা, সেই ছেলেই পরে দেশ বিদেশের এতো এতো চলচ্চিত্র দেখে দেখেই বেড়ে উঠলো এক নতুন পরিবেশে। যে পরিবেশে তার নিজেরও একটা নাম আছে, পরিচয় আছে। সব থেকে বড় উপলব্ধি, ছেলেটা বুঝতে পারলো বড় হয়ে কিছু করার সম্মানের থেকে ছোট থাকতেই বড় কিছু করার আনন্দ পরিমাণে ঢের বেশি!
পাঁচ বছর পর এখন সেই ছেলেটা, অর্থাৎ আমি খুব জোর গলাতেই বলতে পারি, আমার জীবনের সব থেকে কার্যকারী সিদ্ধান্ত ছিলো পাঁচ বছর আগে CFS এর সাথে যুক্ত হওয়া। এখানেই আমি শিখছি, দায়িত্বকে কিভাবে ভালবাসতে হয়।